অন্তর্বর্তী সরকার যে কারণে আগাম নির্বাচনের বিপক্ষে:

ডেস্ক রিপোর্ট :

এশিয়া-প্যাসিফিক জোনের সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাট গতকাল সোমবার (৩ জুন) এক নিবন্ধে দাবি করেছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নবগঠিত ছাত্র নেতৃত্বাধীন এনসিপির পক্ষে বলে মনে হচ্ছে এবং ভোটারদের মুখোমুখি হওয়ার আগে তিনি এনসিপিকে সংগঠিত করার জন্য সময় দিচ্ছেন।সাময়িকীটিতে লেখা হয়েছে, ৯ এপ্রিল বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ঢাকায় মডেল মেঘনা আলমের বাড়ির দরজা ভেঙে তাঁকে আটক করে। তাঁর গ্রেপ্তারের একটি ফেসবুক লাইভ সম্প্রচারের ফলে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় পরে তাঁর আটকের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এই গ্রেপ্তার দেশটির আইন লঙ্ঘন করেছে।এক মাস প্রতিরোধমূলক আটকের পর যখন তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, তখন সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজের সঙ্গে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে মেঘনা দাবি করেন, ইউনূসের বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী তাঁর গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা করেছিলেন। দুই দিন পর তিনি নিরাপত্তার উদ্বেগের কারণে নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনিম খলিলকে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ভিডিওটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সাময়িকীটির দাবি, ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কর্তৃক বাকস্বাধীনতার ওপর দমন-পীড়নের শিকার শত শত মানুষের মধ্যে মেঘনাও রয়েছেন।এতে বলা হয়, নবগঠিত ছাত্র নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) নেতা সারজিস আলমের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে মন্তব্য করার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।আরো উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মে মাসের শেষ সপ্তাহে একজন মহিলা শিক্ষিকাকে মহিলাদের সমান সম্পত্তির অধিকারকে সমর্থন করে একটি নিবন্ধ লেখার জন্য বদলি করা হয়েছিল।সাময়িকীটির মতে, ইউনূসের সমর্থকরা উদার গণতন্ত্রের মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে ভবিষ্যতে ‘ফ্যাসিবাদের উত্থান রোধ’ করার জন্য বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দেওয়ার একমাত্র নেতা হিসেবে তাঁকে তুলে ধরলেও সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেখায় যে ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করছে।সাময়িকীটির মতে, এটি সংস্কারের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি এবং ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক রূপান্তর টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই সংস্কারগুলো কি সত্যিই ইতিবাচক পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্যে, নাকি এগুলো শুধু সরকারের পক্ষপাতী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের সংগঠিত করার জন্য সময় কেনার কৌশল?বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী ও নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা গণ-অভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা গ্রহণের প্রায় ৯ মাস হয়ে গেছে।অন্তর্বর্তী সরকারের মূল এজেন্ডা হচ্ছে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে এবং ভবিষ্যতে হাসিনার মতো কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান রোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা।সাময়িকীটির মতে, তবু, এখন পর্যন্ত, সব অংশীদারের মধ্যে ঐকমত্য তৈরি এবং সংস্কার ও ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরিতে খুব কম অগ্রগতি হয়েছে। এরই মধ্যে সরকার ভিন্নমত পোষণকারীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।

সাময়িকীটি দাবি করেছে, অংশীদারদের ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হলো নবগঠিত এনসিপি কর্তৃক প্রচারিত সংস্কার ধারণার প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষপাতিত্ব। এর মাধ্যমে প্রায়ই অন্য বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ উপেক্ষা করা হচ্ছে।সাময়িকীটি লিখেছে, সমস্যার মূল সূত্রপাত ঘটে যখন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। ছাত্র নেতৃত্বাধীন এনসিপির অনেক সদস্য ‘ছাত্র প্রতিনিধি’ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশনগুলোতে যোগদান করেন এবং সংস্কার প্রস্তাবগুলোর খসড়া করার ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা পালন করেন। বিপরীতে অন্য প্রধান দলগুলো শুধু তাদের ধারণা জমা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, যা মূলত উপেক্ষা করা হয়।এতে দাবি করা হয়, মাত্র তিন মাস বয়সী এবং দেশব্যাপী এক ডজনেরও কম কমিটি রয়েছে এমন দল এনসিপি প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টাদের কাছে সরাসরি ও বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত প্রবেশাধিকার পেয়েছে। এই প্রবেশাধিকারের ফলে এনসিপি অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগুলোকে প্রভাবিত করতে এবং এমনকি গঠন করতে সক্ষম হয়েছে, যখন অন্য দলগুলো তাদের বৈধ দাবিগুলো প্রকাশ করতে লড়াই করছে।সাময়িকীটির মতে, এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় রাতারাতি নিষিদ্ধ করা। এই সরকারি ঘোষণার এক দিন আগে এনসিপি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো বিস্তৃত পরামর্শ ছাড়াই সরকারকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে বাধ্য করার জন্য শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করে। যদিও ইউনূস বেশ কয়েকবার দাবি করেছিলেন যে তাঁর সরকার একতরফাভাবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করবে না।প্রায় একই সময়ে একটি আদালত বিএনপি নেতাকে দক্ষিণ ঢাকার মেয়র ঘোষণা করেন। প্রতিক্রিয়ায় সরকার তা প্রত্যাহার করে। যার ফলে মেয়রের সমর্থকরা রাস্তা অবরোধের মাধ্যমে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরিস্থিতি নিয়ে অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা হতাশা প্রকাশ করেন। উপরন্তু যখন বিএনপি এবং অন্য দলগুলো আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ চেয়ে তাঁকে চাপ দেয়, তখন তিনি একটি রোডম্যাপ প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানান এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণের দিকে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য বিএনপির সমালোচনা করেন।বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও এনসিপির দাবির প্রতি দৃশ্যত বৈষম্যমূলক আচরণ প্রধান রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যে আস্থার ঘাটতি বাড়িয়েছে। ছাত্রনেতা নুরুল হক নুর, যিনি বর্তমানে গণ অধিকার পরিষদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, একটি সংবাদপত্রকে বলেছেন, ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কোনো রোডম্যাপ ভাগ করে নিচ্ছে না। কারণ তারা একটি নতুন দল এনসিপিকে সংগঠিত হতে সাহায্য করতে চায়। তিনি অভিযোগ করেন, এনসিপি সরকারের কাছ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক দাবি করেছেন, ইউনূস এবং তাঁর অন্তর্বর্তী সরকার নীরবে পর্দার আড়াল থেকে ছাত্র নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলটিকে সমর্থন করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *