বুলগেরিয়ায় মুসলিম শাসনের স্মৃতি
বুলগেরিয়ায় মুসলিম শাসনের স্মৃতি:
ডেস্ক রিপোর্ট: কিসেলচোভ, বুলগেরিয়ার রোডোপ অঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। এই গ্রামে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে মিনারহীন একটি ছোট্ট মসজিদ। ছোট্ট মসজিদটি মুসলিম শাসনের সাক্ষী। বর্তমানে বুলগেরিয়া বললে কোনোভাবেই ইসলাম, মুসলমান ও মসজিদের কথা মনে আসে না, অথচ দেশটি ৫’শ বছর মুসলমানের শাসনাধীন ছিল। বর্তমানে বুলগেরিয়ায় মুসলমানের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। মূলত আমি বুলগেরিয়ায় গিয়েছিলাম গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে। আমি ইস্তাম্বুল থেকে গ্রিক সীমান্তবর্তী রোডোপ এলাকায় যাই। সেখানে আমি তিন সপ্তাহ অবস্থান করি। দিনের বেলা আমি লেখালেখি করতাম এবং প্রতিদিন বিকেলে পাহাড়ি পথ ধরে ঘুরে বেড়াতাম। আমি পরিত্যাক্ত ঘর-বাড়ি ও স্থাপনাগুলো দেখে রোমাঞ্চিত হতাম। এক সময় এখানে মানুষের কোলাহল ছিল, কিন্তু এখন সেগুলো পরিত্যাক্ত। আগাছা গ্রামের পথ, বাগান ও ভবনগুলোর দখল নিয়েছে। সূর্যাস্তের আগে নদীর তীরে বসে থাকতাম। সেখানে ধ্যান করতাম, দিনলিপি লিখতাম এবং রাতের আধারকে স্বাগত জানাতাম। আমার অবস্থানের জায়গা থেকে কিসেলচোভ গ্রামটি বেশ দূরের। এবড়োখেবড়ো পথ ধরেই সেখানে যেতে হয়। এক সময় পথটি পাকা ছিল। এখন তা গর্ত ও আবর্জনায় পরিপূর্ণ। এক সময় গ্রামে তিন শতাধিক বাসিন্দা ছিল। তারা ছিল পোমাক মুসলিম। এখন সেখানে মাত্র সাত জন ব্যক্তি সারা বছর বসবাস করে এবং তাদের সবাই বৃদ্ধ। গ্রামের অনেকেই আগে ইউনিয়াম খনিতে কাজ করত। এখন পেনশনের টাকায় তারা জীবিকা নির্বাহ করে। কমিউনিস্ট আমলে গ্রামের স্কুলসহ একাধিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গ্রামের বহু মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। বুলগেরিয়ার জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বেশি মুসলিম। রোডোপ মুসলিম অধ্যুষিত একটি অঞ্চল। শত শত বছর ধরে এখানে তুর্কি ও পোমাক মুসলিমরা বসবাস করে আসছে। ধারণা করা হয়, বুলগেরিয়ায় মুসলমানের আগমন ঘটে খ্রিস্টীয় অষ্টম ও নবম শতকে। তবে ইসলামের প্রসার ঘটে এই অঞ্চল উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসনাধীন হওয়ার পর। পোমাক হলো বুলগেরীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম আদিবাসী। উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর পোমাকরা বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বুলগেরিয়ায় মাত্র দেড় থেকে দুই লাখ পোমাক বাস করে। তারা পোমাক ও বুলগেরিয়ান ভাষায় কথা বলে। পোমাক জনগোষ্ঠি বুলগেরিয়ান সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশিদার। আমি স্মোলিয়ান শহরের চারপাশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে ভ্রমণ করেছি। প্রতিটি গ্রামের মধ্যভাগে একটি মসজিদ আছে, যা ইসলামের সঙ্গে পোমাক সম্প্রদায়ের গভীর সংযোগকে প্রতিভাত করে। তুর্কি শাসনামলে মুসলিম ও খ্রিস্টান জনগোষ্ঠি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত। তখন স্থানীয় জনগণ তুর্কি ইসলামী সংস্কৃতিকে আপন করে নেয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট শাসকরা দেশটি থেকে ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতির শেকড় তুলে ফেলতে চেয়েছিল। তারা বহু ইসলামী প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে এবং মানুষকে ইসলামী বিশ্বাস ও সংস্কৃতি ত্যাগে বাধ্য করে। তারপরও বহু মানুষ সাংস্কৃতিক বিবেচনায় মুসলিম রয়ে গেছে। কমিউনিস্ট শাসন অবসানের পর অনেকেই প্রকাশ্যে ইসলাম চর্চা শুরু করে। আমি যে অঞ্চল ভ্রমণ করেছি তার বেশির ভাগ অধিবাসী মুসলিম। তবে ইসলাম সম্পর্কে তাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। কমিউনিস্ট শাসকদের ইসলামী বিরোধী কার্যক্রমের কারণে বুলগেরিয়ার মানুষ ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি সেখানে বহু মসজিদ দেখেছি যাতে কোনো মুসল্লি নেই। কিছু মসজিদে শুধু জুমার নামাজ হয়। শুধু একটি গ্রামে আমি আজান শুনতে পেয়েছি। যদিও বুলগেরিয়ার মুসলিম খুব বেশি ধর্মপরায়ণ নয়, তবুও তারা রমজান ও ঈদসহ অন্যান্য ইসলামী দিবসগুলো উদযাপন করে। কিসেলচোভের যে মসজিদের কথা আমি প্রথমে বলেছি সেটা সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক কোকারা আমাকে জানিয়েছেন, মসজিদটি তিন শ বছরের পুরাতন। তাঁর দাদা এই মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন ছিলেন। প্রাচীন এই মসজিদের সঙ্গে তাঁর ও স্থানীয় মুসলমানের আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে আছে। কোকারার বয়স ৭৯ বছর। এই বয়সেও তিনি মসজিদটি সংস্কার করতে শত শত ঘণ্টা কাজ করেছেন এবং বহু অর্থ ব্যয় করেছেন। মসজিদের ছাদ ধ্বসে পড়েছিল তিনি তা ঠিক করেছেন। মসজিদটি এখন ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত। কোকারা মসজিদটি রক্ষা করতে চান বুলগেরীয় মুসলমানের সোনালি দিনের স্মারক হিসেবে এবং তাঁর দাদার স্মৃতি হিসেবে। তিনি আশা করেন, এর বিনিময়ে আল্লাহ জান্নাতে তাঁকে ঘর দান করবেন। সিক্রেড ফুটস্টেপস থেকে আবরার আবদুল্লাহর ছায়ানুবাদ