গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট: সমাধানে নজর দিন

১০ এপ্র ২০২৫

গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট: সমাধানে নজর দিন:

ডেস্ক রিপোর্ট: দীর্ঘদিন ধরে রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশ এলাকার আবাসিক, শিল্পকারখানার গ্রাহকরা গ্যাসের সংকটে ভুগছেন। দিনের বেলায় অধিকাংশ গ্রাহকের চুলায় গ্যাস থাকছে না। রান্নার কাজ সারতে রাতে বা গভীর রাতের জন্য মানুষকে অপেক্ষায় থাকতে হয়। বিকল্প হিসেবে অনেক গ্রাহক এখন এলপিজি, ইলেকট্রিক চুলা, মাটির চুলার মতো বিকল্প পদ্ধতিতে চলে যাচ্ছেন। এতে একদিকে জ্বালানির খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনি মাসে মাসে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস না পেয়েও গ্রাহকরা গ্যাসের বিল দিচ্ছেন। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় দিনের বেশির ভাগ সময় গ্রাহকরা গ্যাস পান না। এটা নতুন নয়, দীর্ঘদিন ধরে এমনটা চলছে। ফলে যাদের সামর্থ্য আছে, গ্যাসের লাইন থাকা সত্ত্বেও জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় তারা সিলিন্ডার রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ রাখছেন বৈদ্যুতিক চুলা। কেউবা বৈদ্যুতিক চুলা এবং সিলিন্ডার দুটোই। কারণ বিদ্যুতেরও নিশ্চয়তা নেই। গ্যাস-পরিস্থিতি প্রকৃতই এমন হতাশাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। অনেক গ্রাহকই এখন মনে করেন, গ্যাসের লাইনটা তাদের জন্য অকারণ মাসিক ব্যয়ের একটা অর্থহীন দায়ে পরিণত হয়েছে। দরকারের সময় গ্যাস না পেয়েও মাসে মাসে নির্ধারিত টাকা গুনতে হচ্ছে। দেড় দশকের স্বৈরশাসনে শীর্ষ ব্যক্তিরা এ খাত থেকেও চুরি-জোচ্চুরি, লুটপাট, ঘুষ-দুর্নীতি আর অর্থ পাচারে যতটা তৎপর ছিলেন, তার সিকিভাগ সক্রিয়তাও যদি গ্যাসের উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহে নিয়োগ করতেন, অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হতো। কিন্তু তা হয়নি। গ্যাস সংকটের প্রধান কারণ পুরোনো সরবরাহ লাইন, চাহিদার তুলনায় কম উৎপাদন এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৮০ কোটি ঘনফুট হলেও সরবরাহ মাত্র ২৬০ কোটি ঘনফুট। এই বিশাল ঘাটতির কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি লেগেই রয়েছে। মোট চাহিদার ৬২ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে জ্বালানি বিভাগ। এতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন। কয়েক বছর ধরে গ্যাস সংকট চলছে, এখন তা প্রকট হয়েছে। সংকট লাঘবে দেশি গ্যাসের অনুসন্ধানে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পরিকল্পনাধীন ১০০টি কূপ খনন প্রকল্প থেকে জরুরি ভিত্তিতে তারা এ বছরই অন্তত সাতটি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। পুরোনো কিছু গ্যাসকূপের ওয়ার্কওভারও করা হবে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার একের পর এক প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। কিন্তু সে অনুযায়ী জ্বালানির সংস্থানে কোনো নজর দেয়নি। দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে অবহেলা করে আমদানিতে ঝোঁক ছিল বেশি। শুধু আবাসিক গ্রাহকদেরই সমস্যা নয়, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের প্রভাব পড়তে পারে শিল্প-কলকারখানায়ও। এ দুই জ্বালানির উৎপাদন হ্রাস এবং চাহিদা বৃদ্ধির এই উভয় সংকট মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই প্রয়োজনীয় কিছু প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নিলেও সার্বিক সমস্যা সমাধানে তা পর্যাপ্ত নয়। এ জন্য কর্তৃপক্ষকে যেমন উৎপাদন-বিপণন-সরবরাহ সুষ্ঠু রাখা এবং সিস্টেম লস বন্ধে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। অন্যদিকে গ্রাহকের সচেতনতা এবং সহযোগিতাও প্রয়োজন। গ্যাস-বিদ্যুতের অপচয় রোধ, পরিমিত ব্যবহারও নাগরিকের পবিত্র কর্তব্য। পবিত্র রমজানে এ ক্ষেত্রও দাবি করে কৃচ্ছ্রসাধন। দেশের শিল্প খাত মারাত্মকভাবে ধুঁকছে। আর তার প্রধান কারণ গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট। চাহিদার তুলনায় গ্যাস মিলছে অনেক কম। ফলে ব্যাপকভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সময়মতো পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ফলে বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ। আবারও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উৎপাদন। কেবল আরএমজি সেক্টরেই ২০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অন্য দিকে ক্রমাগতভাবে কমছে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন। আপাতত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি খুব একটা বাড়ানোর উপায় নেই। আমদানি বাড়াতে হলে নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। আগামী দুই বছরেও নতুন টার্মিনাল স্থাপন ও চালু করার সম্ভাবনা কম। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গত শনিবার গ্যাস সরবরাহ করা হয় ২ হাজার ৬৯১ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি ছিল এক হাজার ৩০৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সরবরাহ করা গ্যাসের মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এসেছে এক হাজার ৯০৯ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানি করা এলএনজি থেকে এসেছে ৭৮১ মিলিয়ন ঘনফুট। এ দিকে রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে। সেই বাড়তি চাহিদা পূরণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বেশি পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এতে আগামী দিনে শিল্পে গ্যাস সংকট আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৯টি চলমান প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। আর মোট তেল গ্যাস অনুসন্ধান ব্লক রয়েছে ৪৮টি। গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। পেট্রোবাংলা সরবরাহ করতে পারছে ২৫০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে উচ্চ দামে এলএনজি আমদানি করে দৈনিক প্রায় ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। যা এড়িয়ে স্বনির্ভরতার কৌশল খুঁজতে হবে।