মালয়েশিয়ায় স্বপ্ন পূরণে ‘দাস’ হয়ে সাগরযাত্রা

১০ এপ্র ২০২৫

মালয়েশিয়ায় স্বপ্ন পূরণে ‘দাস’ হয়ে সাগরযাত্রা:

ডেস্ক রিপোর্ট: বেশি বেতনে চাকরি আর উন্নত জীবনের আশায় অনেকেই অবৈধ পথে বিদেশযাত্রা করেন। এক্ষেত্রে জীবনের মায়া ত্যাগ করে স্বপ্ন পূরণের কল্পনায় ভাসেন তারা। গত মঙ্গলবার বঙ্গোপসাগর থেকে ‘এফভি কুলসুমা’ নামে মাছ ধরার একটি নৌকা জব্দ করে নৌবাহিনী। সেই নৌকার যাত্রী ২২১ জন, গন্তব্য মালয়েশিয়া। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ্যে ১৬৭ জনই রোহিঙ্গা। ৪২ জন বাংলাদেশি নাগরিক; বাকি ১২ জন দালাল ও মাঝি-মাল্লা। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা সাতজনের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। জানা যায়, দাস হিসেবে বিক্রি হওয়ার পর বিনা টাকায় নৌকায় উঠার ব্যবস্থা হয় কারও কারও। প্রথমে তাদের নেওয়ার কথা ছিল থাইল্যান্ড; আর সেখান থেকে মালয়েশিয়া। যদিও থাইল্যান্ডে পৌঁছানোর পরই মাথাপিছু টাকা পরিশোধ করবেন বলে দালালদের প্রতিশ্রুতি দেন অনেকের স্বজন। তবে টাকা না পেলে দালালরা তাদের অন্য মানবপাচার চক্রের কাছে বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছিল। সেই নৌকায় ছিলেন রোহিঙ্গা জাহেদ হোসেন। তিনি জানান, ক্যাম্পে কোনো কাজ না থাকায় হতাশ ছিলেন। এক দালালের কাছ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তাব পেলে খুশি হন। গন্তব্যে পৌঁছালে স্বজনের টাকা শোধ করার কথা ছিল। শুরুতে দালালদের এক টাকাও দেওয়া হয়নি। যদিও নৌকায় ওঠার পর জানতে পারি, ওই দালাল ২০ হাজার টাকায় আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। হয়তো জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করত চক্রটি। টেকনাফের ৭ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা রোহিঙ্গা তরুণী নুর কলিমা। তার বোন জামাই আজিম উল্লাহ এই প্রতিবেদককে জানান, মোবাইল ফোনে মালয়েশিয়াপ্রবাসী এক যুবকের সঙ্গে নুর কলিমার বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত করে পরিবার। কীভাবে কলিমা মালয়েশিয়া পৌঁছাবেন, ওই যুবক দালালদের মাধ্যমে ঠিক করে। বিদেশে পৌঁছানোর পরই টাকা পরিশোধের কথা ছিল। মালয়েশিয়াগামী নৌকার একাধিক যাত্রী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জনপ্রতি ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা দেওয়ার কথা জানিয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাচ্ছিলেন তারা। টেকনাফের কল্যাণপাড়ার বাসিন্দা মো. ইমরানের বিদেশযাত্রার গল্পও আবার অন্য রকম। দুই ভাই, তিন বোন ও মাকে নিয়ে তার পরিবার। বাবা দীর্ঘ দিন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। ইমরানের বোন উম্মে হাবিবা জানান, ঈদের পর শাহ্‌পরীর দ্বীপে আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যান পরিবারের সদস্যরা। গত রোববার বাড়ি ফিরে দেখেন, ইমরান ঘরে নেই। সে মাদ্রাসার নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। গত মঙ্গলবার বঙ্গোপসাগর থেকে মালয়েশিয়াগামীদের উদ্ধারের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হলে সেখানে ইমরানকে দেখে পরিবারের সদস্যরা বিস্মিত। এরপর অন্যদের মতো তাকেও পরিবারের জিম্মায় দেয় প্রশাসন। ইমরানের দাবি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক দালালের সঙ্গে তার পরিচয়। তার প্রলোভনে পা দিয়ে গত রোববার ঘর ছাড়ে সে। প্রথমে টেকনাফের একটি গহিন পাহাড়ে নিয়ে অনেকের সঙ্গে তাকে রাখা হয়। মূলত সেখান থেকে পরদিন সোমবার দিবাগত রাতে টেকনাফের নোয়াখালীপাড়ার ঘাট থেকে প্রথম দফায় ছোট নৌকায় সমুদ্রে নেওয়া হয়। সেই যাত্রাটি ছিল প্রায় ৫০ মিনিটের। সেখানে অপেক্ষমাণ মাছ ধরার নৌকায় তোলা হয়। এভাবে একের পর এক ছোট নৌকায় করে সমুদ্রে আনা হয়েছিল। তিন দিনে একবার খাবার দেওয়া হয়। গাদাগাদি করে দুই শতাধিক লোক নৌকায় তোলা হয়। তিনি আরও জানান, অনেককে নৌকার নিচের বদ্ধ অংশে যাওয়ার নির্দেশ দেয় দালাল ও মাঝি-মাল্লারা। নিচে দম বন্ধ হওয়ার দশা। অনেকে সেখানে যেতে রাজি না হওয়ায় মারধর করা হয়েছিল। খাবারের সংকট ছিল। ইমরান ঘর ছাড়ার সময় ব্যাগে ১২ লিটার পানি, আচারসহ কিছু শুকনো খাবার নেয়। সোমবার রওনা হয়ে শুক্রবার সবাইকে মালয়েশিয়া পৌঁছে দেবে বলে জানায় চক্রটি। টেকনাফের বাগগুনাপাড়ার বাসিন্দা আবদুল মালেক বলেন, স্থানীয় দালাল আব্দুল আলীর মাধ্যমে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছিলাম। দালালকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। বাকি টাকা থাইল্যান্ড পৌঁছালে দেওয়ার কথা ছিল। এর পর আমাদের মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলা হয়। পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশকিছু দিন রোহিঙ্গা ও বাঙালি দালাল চক্রের সদস্যরা টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা ও ক্যাম্প থেকে নানা কৌশলে তাদের সংগ্রহ করে। কাউকে ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেয়। আবার কোনো তরুণী এ চক্রের যৌন নিপীড়নের ফাঁদে পড়ে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ ঘটনায় কোস্টগার্ড বাদী হয়ে মামলা করেছে। ভিকটিমদের পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়। দালাল ও মাঝি-মাল্লার মধ্যে নৌকা থেকে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে; তারা হলেন– টেকনাফের বাহারছড়ার রাসেল, জসিম, সাইফুল ইসলাম, ধলু মিয়া, ইমাম হোসেন; কক্সবাজারের জামতলী ক্যাম্পের আলম, ওমর ফয়সাল, মহিব উল্লাহ, রফিক, আরিফ, জোহার ও সেলিম উল্লাহ। এ মামলায় পলাতক আসামিরা হলেন– টেকনাফের বাহারছড়ার জসিম, সাইফুল আলম, আব্দুল আলী, আবদুল করিম, সাব্বির আহমদ সবুয়া; রামু শহরের মুল্লুক। মুল্লুকই নৌকার মালিক। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সাগরপথে মানব পাচারের সময় কক্সবাজারে দেড় হাজারের বেশি লোককে উদ্ধার করা হয়, তাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা। পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের আর্থসামাজিক অনগ্রসরতা ও পরিবেশগত অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ফাঁদ পাতে মানব পাচার চক্র। অবিবাহিত নারীকে বিয়ের ফাঁদে ফেলা হয়। চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে যৌন নিপীড়ন, প্রতারণার বিয়ে ও জবরদস্তি শ্রমসেবা আদায়ের অভিপ্রায় ছিল চক্রটির। সংঘবদ্ধ পাচারকারী বাঙালি ও রোহিঙ্গা গ্রুপ অবৈধভাবে সাগরপথে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় মানুষ পাচার করে আসছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সাগর থেকে যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের কারও পাসপোর্ট নেই। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সাগর কিছুটা শান্ত থাকে। এ সময় নৌকা ও ট্রলারে মানব পাচার করে সংঘবদ্ধ চক্র।