রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান ও ফিলিস্তিন: এক অনন্য কূটনৈতিক বন্ধন

রাজনীতি ১০ এপ্র ২০২৫

রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান ও ফিলিস্তিন: এক অনন্য কূটনৈতিক বন্ধন:

ডেস্ক রিপোর্ট: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য যেসব রাষ্ট্রনায়ক নিরলস পরিশ্রম করেছেন, তাঁদের মধ্যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন অন্যতম। তিনি শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেননি, বরং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিসরে বাংলাদেশের সক্রিয় উপস্থিতি ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে কার্যকর কৌশল গ্রহণ করেন। এ প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিন ইস্যুতে তাঁর সুদৃঢ় অবস্থান ও নিষ্ঠাবান সমর্থন ছিল জাতীয় কূটনীতির একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর, বাংলাদেশ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত, দরিদ্র ও আন্তর্জাতিকভাবে একেবারে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই কঠিন বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক স্বীকৃতি অর্জন ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রথম থেকেই শহীদ জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, অর্থনৈতিক সহায়তা এবং রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করা সম্ভব। ফিলিস্তিন ইস্যু ছিল মুসলিম বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগঘন সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম মুসলিম বিশ্বে সহানুভূতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া কেবল নৈতিক দায় ছিল না, বরং কৌশলগতভাবে মুসলিম বিশ্বের আস্থা অর্জনের একটি কার্যকর উপায়ও ছিল। এই প্রেক্ষাপটে শহীদ জিয়ার ফিলিস্তিনপ্রীতি ছিল সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক বিচক্ষণতার বহিঃপ্রকাশ। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর শহীদ জিয়া স্পষ্টত ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে সমর্থন করেন। তিনি ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (PLO)-কে ফিলিস্তিনিদের বৈধ প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেন। এই পদক্ষেপ ছিল সে সময়ে সাহসিকতাপূর্ণ, কারণ মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতিতে পিএলও-র অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে মতভেদ ছিল। বাংলাদেশে পিএলও-র দূতাবাস স্থাপন করার অনুমতি দেওয়া এবং তাকে পূর্ণ রাষ্ট্রদূতের মর্যাদা দেওয়া ছিল শহীদ জিয়ার ফিলিস্তিনপ্রীতির একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত। বিশ্বের অনেক দেশ তখনও পিএলও-কে একটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে বিবেচনা করত, কিন্তু শহীদ জিয়া এর বিপরীতে গিয়ে তাঁদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেন। শহীদ জিয়া জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেছেন এবং তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন। ১৯৮০ সালে ওআইসি-র (Organization of Islamic Cooperation) সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে তিনি দৃঢ়ভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে ধরেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ওআইসি-র একটি সক্রিয় সদস্যে পরিণত হয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। শহীদ জিয়ার আমলে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ইসলামী দেশগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে উন্নয়ন প্রকল্প ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় অংশ নিতে সক্ষম হয়। রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান তাঁর সামরিক অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্ব দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে একটি সাহসী পদক্ষেপ নেন—ফিলিস্তিনিদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ ও কৌশলগত সহায়তার প্রস্তাব দেন। তাঁর আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা ফিলিস্তিনিদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরিত হন বলে বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি ছিল মুসলিম বিশ্বের ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ন্যায়বিচারের প্রতি বাংলাদেশের একটি বলিষ্ঠ অঙ্গীকার। এছাড়াও, তিনি ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নেন। তৎকালীন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে খাদ্য, ওষুধ ও ত্রাণ পাঠানো হয় ফিলিস্তিনে। এটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নিপীড়িত জনগণের প্রতি এক বিরল মানবিক বার্তা ছিল। শহীদ জিয়ার শাসনামলে ফিলিস্তিন ইস্যুটি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে একটি গণআন্দোলনের চেহারা নেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন, রেডিও ও সংবাদপত্রে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র নিয়মিতভাবে প্রচারিত হতে থাকে। স্কুল-কলেজে ছাত্র সংগঠনগুলো ফিলিস্তিনের পক্ষে মিছিল-মিটিং করে। এই সমর্থনের পিছনে সরকারের নীতিগত অবস্থান এবং শহীদ জিয়ার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির একটি বড় ভূমিকা ছিল। তাঁর নির্দেশে বাংলাদেশে ফিলিস্তিন সংহতি দিবস পালন করা হয়, যার মধ্য দিয়ে জনমনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়। বাংলাদেশি জনগণও এই ইস্যুতে গভীরভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য দোয়া ও সমর্থনের হাত বাড়ায়। শহীদ জিয়ার ফিলিস্তিনপ্রীতির কৌশল শুধু নৈতিক ও আদর্শিক ছিল না, এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সউদী আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমানসহ অন্যান্য আরব দেশগুলোর কাছ থেকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক সহায়তা লাভ করে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমবাজারের প্রসার ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এই সম্পর্ক অনেক বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আজকের রেমিট্যান্স নির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপনের পেছনে শহীদ জিয়ার সেই কূটনৈতিক বিচক্ষণতার অবদান অনস্বীকার্য। আজও ফিলিস্তিন প্রশ্ন আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক অনিবার্য ইস্যু। ইসরায়েলি আগ্রাসন, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন এবং গাজা উপত্যকার সংকট বিশ্ববিবেককে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করে। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানও ফিলিস্তিনের পক্ষে, কিন্তু শহীদ জিয়ার মতো সাহসী নেতৃত্বের অভাব অনুভূত হয়। তিনি ছিলেন এমন একজন নেতা যিনি নীতিগত অবস্থান গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হতেন না, বরং ন্যায়ের পক্ষে অটল থাকতেন। তাঁর জীবন, দর্শন ও কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ যদি আজও ফিলিস্তিনের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে চায়, তাহলে শহীদ জিয়ার কৌশলগত পরিণতিবোধ, নৈতিক নেতৃত্ব এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নিষ্ঠা থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের ফিলিস্তিনপ্রীতি ছিল তার বহুমাত্রিক রাষ্ট্রনায়কত্বের একটি উজ্জ্বল দিক। তিনি শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, মানবিক, সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তার এই অবদান আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে করেছে মজবুত ও ফলপ্রসূ। আজকের প্রজন্মের উচিত তার সেই দূরদর্শী ভূমিকার মূল্যায়ন করা এবং তাঁর দেখানো পথে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার থাকা।

ট্যাগ