ট্রাম্পের শুল্কচাপে বিশ্ববাজারে কমেছে জ্বালানি তেলের দাম, কতটা সুফল পাবে বাংলাদেশ?
ট্রাম্পের শুল্কচাপে বিশ্ববাজারে কমেছে জ্বালানি তেলের দাম, কতটা সুফল পাবে বাংলাদেশ?:
ডেস্ক রিপোর্ট: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার পর বিশ্ববাণিজ্যে আবারও শুরু হয়েছে শুল্কের ‘শক থেরাপি’। সম্প্রতি চীন, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যার পাল্টা জবাব দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। এই বাণিজ্য উত্তেজনার সরাসরি প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে, যার একটি বড় প্রভাব পড়েছে জ্বালানি তেলের বাজারে। বিশ্ববাজারে দাম সর্বনিম্নে বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড ওয়েলের দাম নেমে এসেছে প্রায় ৬০ ডলারের কাছাকাছি, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় এই দাম ছিল ১৩৯ ডলার পর্যন্ত। বিশ্বব্যাপী চাহিদা স্থবিরতা, শুল্কের প্রভাব এবং সরবরাহ বেশি থাকার কারণে এই পতন ঘটেছে। বাংলাদেশ কতটা সুফল পাবে? বাংলাদেশ ১০০% জ্বালানি তেল আমদানি নির্ভর দেশ। ফলে বৈশ্বিক বাজারে দাম কমলে দেশীয়ভাবে তার সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তবে সেই সুফল নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের ওপর: ১. নতুন মূল্য ও মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি বাংলাদেশে এখন স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু আছে। মে মাসে প্রতি লিটার জ্বালানি তেলে দাম কমেছে ১ টাকা। আজ বুধবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৫ টাকা থেকে কমিয়ে ১০৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পেট্রোলের দাম প্রতি লিটার ১২২ টাকা থেকে কমিয়ে ১২১ টাকা ও অকটেনের দাম ১২৬ টাকা থেকে কমিয়ে ১২৫ টাকা করা হয়েছে। নতুন দাম ১ মে থেকে কার্যকর হবে। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে বেড়েছিল ১ টাকা। মার্চ ও এপ্রিল মাসে জ্বালানি তেলের দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়। দেশের বাজারে দাম কমলেও তাৎক্ষণিক নয়, কমপক্ষে এক মাস পর তার প্রভাব পড়ে। ২০২৪ সালের মার্চ থেকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ শুরু করে সরকার। সে হিসেবে প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হয়। জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের সূত্র নির্ধারণ করে নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। এতে বলা হয়, দেশে ব্যবহৃত অকটেন ও পেট্রল ব্যক্তিগত যানবাহনে বেশি ব্যবহৃত হয়। তাই বাস্তবতার নিরিখে বিলাসদ্রব্য (লাক্সারি আইটেম) হিসেবে সব সময় ডিজেলের চেয়ে অকটেন ও পেট্রোলের দাম বেশি রাখা হয়। জ্বালানি তেলের মধ্যে উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েলের দাম বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারণ করবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করে বিপিসি। আর ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। ২. ডলার দাম একটি বড় বাধা বর্তমানে প্রতি ডলার কিনতে হচ্ছে ১২২ টাকা, যেখানে ২০২২ সালে ছিল ৮৫-১০৫ টাকা। ডলারের এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি খরচ অনেকটাই বেড়েছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশীয় বাজারে আগের দামের মতো কমানো সম্ভব হচ্ছে না। ৩. পরিশোধনাগার ও মজুতের ঘাটতি দেশে কেবল একটিই তেল শোধনাগার (১৯৬৮ সালের), যার বার্ষিক পরিশোধন ক্ষমতা মাত্র ১৫ লাখ টন। মোট চাহিদা প্রায় ৬০-৬৫ লাখ টন, যার বড় অংশই পরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করতে হয়। কম দামে তেল কিনে মজুত করার সক্ষমতাও সীমিত, যার ফলে বাজারে দাম কমার সুফল পুরোপুরি পাওয়া সম্ভব হয় না। ৪. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সম্ভাব্য ইতিবাচক প্রভাব ডিজেল হচ্ছে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জ্বালানি (৭৫%)। এর দাম কমলে কৃষি, পরিবহন ও শিল্প উৎপাদন খরচ কমে গিয়ে পণ্যমূল্য কমতে পারে, যা মূল্যস্ফীতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ৫. মূল্য নির্ধারণ সূত্র নিয়ে প্রশ্ন সিপিডি ও বিভিন্ন অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান দামের কাঠামো বিপিসির অতিরিক্ত মুনাফা ধরে নির্ধারিত, যা ত্রুটিপূর্ণ। বাজারভিত্তিক হালনাগাদ সূত্র প্রয়োগ করলে লিটারে ১০-১৫ টাকা পর্যন্ত কমানো সম্ভব। বাংলাদেশের সম্ভাব্য লাভ দিক সম্ভাব্য প্রভাব আমদানি খরচ কমবে, তবে ডলার দামের কারণে পুরোটা নয় উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় হ্রাস পাবে, যদি দাম সমন্বয় হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সম্ভাবনা সরকারি রাজস্ব কিছুটা কমতে পারে ভোক্তার সুবিধা নির্ভর করছে দ্রুত মূল্য সমন্বয়ের ওপর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়া নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুযোগ। তবে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, ডলারের দামের চাপ এবং মূল্য নির্ধারণের ধীর গতি সেই সুফলকে পুরোপুরি বাস্তবে রূপ দিচ্ছে না। নীতিনির্ধারকদের উচিত দ্রুততম সময়ে বাজারভিত্তিক মূল্য সমন্বয় করে ভোক্তাদের স্বস্তি দেওয়া, যাতে দেশের উৎপাদন, পরিবহন ও সাধারণ জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।